করোনার কারণে গত দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই পরিস্থিতিতে সরকার নানাভাবে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার চেষ্টা করছেন। টেলিভিশন অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা করছেন। তবে অসচ্ছল অনেক শিক্ষার্থী পাঠদানের অংশ নিতে পারছেন না। মূলত অর্থনৈতিক সংকটে প্রয়োজনীয় ডিভাইস ও ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় শিক্ষার্থীরা এসব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই অবস্থায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) যেসব শিক্ষার্থীদের আর্থিক সঙ্কট আছে তাদের অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

পাশাপাশি ইন্টারনেট সুবিধার জন্য নেটওয়ার্ক সচল আছে এমন সংযোগ সরবরাহ করছে কর্তৃপক্ষ। এর মাধ্যমে তারা শতভাগ ছাত্র-ছাত্রীর অনলাইন শিক্ষায় উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পেরেছে। একইসঙ্গে যেসব শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার করোনায় আক্রান্ত তাদের পাশেও দাঁড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতিতে যখন অনলাইন কার্যক্রমের শুরু করা হয় তখন অনেক শিক্ষার্থীই ডিভাইসসহ নেটওয়ার্ক সুযোগ-সুবিধা না থাকাতে অংশ নিতে পারছিলেন না।

এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অনলাইন সিস্টেম থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে ভার্চ্যুয়াল ফরম পাঠায় এবং এতে কার কী চাহিদা, তা পূরণ করতে বলে। এসব ফরম পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন ও ল্যাপটপ কেনার জন্য সুদহীন ঋণ দেয়। উচ্চগতির ইন্টারনেটের সংযোগের বিল পরিশোধেরও সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিষ্ঠানটি। সবার কথা চিন্তা করে ৫ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে অনলাইনে নিজস্ব ই-মেইলে দেওয়া ফরমের মাধ্যমে জরিপ চালানো হয়।

এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয় কোন শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট সংযোগ কেমন। ভালো স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ আছে কি না। ইন্টারনেট কেনার সামর্থ্য আছে কি না। জরিপে ৩৭০ শিক্ষার্থী জানান, তাদের অনলাইনে ক্লাস করার মতো ভালো স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ নেই। বুয়েট সেসব শিক্ষার্থীকে অনলাইন আবেদনের ভিত্তিতে বিনা সুদে ৩০ হাজার করে টাকা দেয়। এভাবে শতভাগ শিক্ষার্থীকে স্মার্টফোন ও ল্যাপটপের আওতায় নিয়ে আসা হয়। যেসব শিক্ষার্থীর ক্লাস করতে গেলে ইন্টারনেটের ডেটা কিনতে সমস্যা ছিল, তাদের প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়।

১ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থী এ সুবিধা পেয়েছেন। তিনটি মুঠোফোন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ইন্টারনেট ডেটা প্যাকেজ চালু করে ৬২৫টি সিম দেওয়া হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের, যাতে তারা ফ্রি ক্লাস-পরীক্ষা দিতে পারেন। কোন এলাকায় কোন মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক ভালো বা ইন্টারনেটের গতি ভালো, তা জরিপের মাধ্যমে জেনে সেই শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের সেই কোম্পানির সিম দেওয়া হয়। আবার ইন্টারনেটের গতি যদি কোনো এলাকায় ভালো না হয়, তাতে ওই অভিযোগের ওপর নির্ভর করে সেই এলাকায় ইন্টারনেটের গতি উন্নতি করার কথাও জানানো হয়।

একই সঙ্গে শিক্ষকদেরও ভালো ডিভাইসের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বুয়েট শিক্ষকদের বিনা সুদে ১৩৩ জন শিক্ষককে ৪৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনলাইন পাঠদানের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে অনলাইন ক্লাস শুরু করে বুয়েট। বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে—এমন শিক্ষার্থীদের ইউপিএস ও পাওয়ার ব্যাংক কেনার জন্য বিনা সুদে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়। যেসব শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাদের ৩ হাজার ৫০০ টাকা ও যাদের পরিবারের কেউ আক্রান্ত, তাদের ২ হাজার ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়।

মোট ৪৬৯ শিক্ষার্থীকে এ সেবার আওতায় আনা হয়। একই সঙ্গে শিক্ষকদেরও ভালো যন্ত্রের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষ বিনা সুদে ১৩৩ শিক্ষককে ৪৫ হাজার টাকা করে দেয়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের টিকা পেতেও সহায়তা করে। বুয়েটের ২ হাজার ১২০ জন শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে টিকা নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, অনেকেরই অনলাইনে ক্লাস করার মতো ভালো স্মার্টফোন ছিল না। বুয়েট থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়ে সেটি কেনা সম্ভব হয়েছে। আমাদের ইন্টারনেটের প্যাকেজ কেনার জন্য মাসে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়।

এটি আমাদের অনলাইন ক্লাসে খুবই কাজে লাগছে। এছাড়া করোনা আক্রান্তদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে বুয়েট। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এ বিষয়ে বুয়েটের উপাচার্য ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চর্চা চালু রাখার প্রয়োজনীয়তা চিন্তা করে পরীক্ষামূলকভাবে অনলাইনে ক্লাস চালু করে বুয়েট।

এ জন্য কমিটি করে আলাদাভাবে সবকিছু অনলাইনেই করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেহেতু করোনায় বুয়েটের বৈদ্যুতিক বিলের পরিমাণ ও আরও কিছু খরচ কমে যায়, তাই সিদ্ধান্ত হয় বেঁচে যাওয়া এসব খরচ দিয়ে যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপকার হয়, এমন কাজে লাগানো হবে। তারই অংশ হিসেবে মূলত এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।